১. উৎসব
মগজের কোষে উৎসব, হুল্লোড়, করুণ পিয়ানো
বাঁশির শব্দে অলৌকিক সিম্ফনি, অবিকল রথের মেলার দৃশ্য
কেউ একজন বৃদ্ধাঙুলে কলা দেখায়, চারদিকে কলার কারিশমা
কেউ কাড়াকাড়ি করে জলে নামে, জল এখানে অনেকদূর—তবু নামে
কে একজন কলা ধরবে এই ছলে জলের মহিমায়
অমিয় লাবণ্য ছুঁয়ে দিতে ফুটন্ত কিশোরীর বুক খামচে ধরে
এই দৃশ্য কেউ দেখে, কেউ দেখে না,
খুব ধোপদুরস্ত এক যুবক চারদিক আদ্যোপান্ত দেখে নিয়ে
তার ইস্তি করা জামা সপাটে খুলে ফেলে, সলাজ তার ঘনকৃষ্ণ চুল
সে খুব গোপনে একটুকরো মোহন হাসি, ভালোবাসা নিয়ে জলে নামে
জলের অতলে ঝিনুকের মতো ডিঙা নাও
সে খুব সন্তর্পণে জলকুমারির নাভি খুঁজে ফেরে,
কোথাও তুখোড় হাসির শব্দ, দলাদলা যুগল ভোমরা
চোখে অলীক সাম্পান, জলের ঝাপটায় কারো সিঁদুর ভিজে যায়
কেউ কপালে তিলক, নাসাগ্রে দিঘল সন্ন্যাসিনী আঁকে
দিনভর ব্যস্ত কুমোরের মতো এক লোক
জলের কিনারে ত্রিশূল ছায়ায় অবিশ্রান্ত ভ্রু আর ঠোঁট কাঁপায়,
একদিকে কাঁচের আয়নায় বিম্বিত ফেরিওয়ালা, দু’হাতে সম্মোহন
হাঁকডাক, জরির পুতুল, দমহীন ঘড়ি, গোলগাল চাকতি
অদূরে কয়েকটি ঘুড়ি অদৃশ্যে অন্তরীক্ষে উড়ে যায়
এদিকে মিষ্টির ঝাকা মৌমাছি টেনে এনে প্রবঞ্চনা প্রতারণা শেখায়,
উৎসবের এই দৃশ্যে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা
এক বিবাগী বাউল দুতারায় নৈঃসঙ্গ্য ছড়ায়,
এই হচ্ছে উৎসব, মগজে রঙিন প্রলয়, বিমুগ্ধ প্রণয়
কেনাবেচা, দাপাদাপি, বাঁশিতে ফুঁ, চুড়ির রিনিকি,
হুল্লোড়, নিথর হওয়ার জন্য কুদোকুদি
ক্লান্তি, ঘুম, বিরান মাঠের স্তব্ধতা এবং অবশেষে
থাক, এখন মগজ খুবই জঞ্জালে ভরে আছে
চলো, এবার সবাই মিলে যে যার মতো ঘরে ফিরি।
২. বারোমাইস্যা
তোমার জন্য সারাটাদিন অপেক্ষমাণ
ধুলোয় ওড়ে ঢেউ খেলানো মুগ্ধ বিকাল
তোমার কোনো খোঁজ মেলে না, কোথায় থাকো?
কার চুলোতে বৃষ্টিমুখর আগুন মাখো?
আমার জন্য দৃষ্টি না হয় সামান্যতম
মরুভূমির তৃষ্ণা মেটাও মরীচিকায়!
তোমার জন্য সকাল আসে পাখির পায়ে
নূপুর বাজে রুপোর রোদে বারুদ বায়ে
ঈর্ষাকাতর হৃদয় আমি কোথায় রাখি!
কার সোহাগে রাত্রিগুলোয় অনল মাখি!
কোথায় থাকো? কোন চুলোতে, কার আঁচলে?
রক্তে মোহন পুষ্প খেলাও ফাগুন সাজো?
আমার জন্য তোমার মধ্যে ভালোবাসার
চিলতেখানিক নেই যে আমি ভালোই জানি
জেনেও তবু কোন আশাতে সমস্ত রাত
তোমার জন্য ভালোবাসার গরল রাঁধি!
কোথায় থাকো? কোন চুলোতে কার বাগানে
গোলাপ ঘ্রাণে হৃদয় খুলে খোঁপায় বাঁধো?
এবার তবে নীল আগুনে আমায় পোড়ো
পুষ্পরেণুর বৃষ্টিধারায় কোমল করো
তীক্ষ্ণ ছোরায় রক্তে আমার মরণ লেখো
লালিম রাঙা ভালোবাসার শোলোক শেখো
এবার তবে বদ্ধ মনের দুয়ার খোলো
তুমুল ঝড়ে হৃদয় জলে জোয়ার তোলো।
৩. রাজকাহন
চারদিকে সম্রাটের ছবি, পুনর্জীবিত
এইসব রাজন্যে ছেয়ে আছে তৃতীয় বিশ্বের যত দেশ
তাদের আত্মা ও গতর বাহারি আলখাল্লায় সজ্জিত
রূপান্তরিত দেহাবয়ব প্রাচীন জরিদার পোশাকের বদলে
গণতন্ত্রের নিখুঁত বুনটের নামাবলীতে ঢাকা
যদিও প্রাচীন রাজাদের মতো হাতে দণ্ড নেই, তির নেই
তবু তারা সুবেশ দণ্ডধর, অদৃশ্য দক্ষ তিরন্দাজ
অর্জুনের মতো নির্ভুল নিশানায় বিদ্ধ করেন পাখির মস্তক,
তাদের রাজ্যে দিনভর বস্ত্রহরণের পালা চলে
গেরস্তের গোলাঘর নিশিকুটুম্বের কলতানে মুখর হয়ে ওঠে
দুর্যোধনেরা পাশাখেলায় জিনে নেয় রাজ্যপাট
ভূমিপুত্ররা বনবাসে যায়
তাদের জমিতে জমিতে ওড়ে দখলিস্বত্বের লাল নিশান,
নদীগুলো ভাঙতে থাকে, ভূমিধসে পাহাড় পতিত হয়
ফেনার বদলে সমুদ্রে ভেসে ওঠে নীল তিমিদের লাশ
আকাশ কার্বনে ঢেকে যায়, বাস্তুচ্যুত পাখির বিলাপ
পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে সুদূরে পালায়
মুগ্ধ রাজন্যবর্গ এইসব দৃশ্যে এত মোহিত হন যে
সুরাপায়ীর মতোই উন্মাতাল নৃত্যে মত্ত হয়ে ওঠেন,
মঞ্চের পেছনে কতিপয় দ্রোণাচার্য নিঃশব্দে
সতরঞ্জের পট সাজাতে সাজাতে গূঢ় খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন
ঘোড়াগুলি হ্রেষাধ্বনি করে, হাতিরা বৃংহিত
দূরে দুন্দুভি বাজে পৃথিবীর তাবৎ বরকন্দাজ কুরুক্ষেত্রে জড়ো হন,
পর্দার ওপাশে আবছা আলোয় অট্টহাসিতে ভেসে ওঠে
পিচাশের মতো নতুন রাজাধিরাজের রক্তাক্ত বিভৎস মুখ।
৪. ফাল্গুনে
ঘনিয়ে ওঠে প্রবল ধূলিঝড়
হৃদয় বনে পুষ্প রাশি রাশি
ফাগুন এসে হানলো মধুস্বর
পাতায় ফোটে শ্যামের মিহি বাঁশি
কোকিল তোলে সুরের কুহু স্বর
শরীর ভরা নদীর কলতান
তোমার চোখে আগুন খরতর
দুকূল ভেঙে পোড়ায় দেহখান
শিমুল ডালে অনল পোড়া ছাই
তুষের মতো দহন অনুক্ষণ
চিকন ঠোঁটে প্রাচীন তুমি রাই
রাঙিয়ে দিলে হরিণ গাঁথা মন।
৫. একটা ছেলে আর একটা মেয়ের গল্প
ছেলেটা বললো হেসে হেসে
একটা কাকই কিনে আনি
লালচে রঙের ফিতেয় বাঁধবো চুল,
মেয়েটা চললো ভেসে ভেসে
বললো, জানি জানি
তুমি আমার নীলচে রঙের ভুল,
যখন আমি পরি তোমায় কানে
হিরেয় গড়া দুল
তুমি তখন নাচতে থাকো মনে
কান্না ভেজা রোল,
ছেলেটা উড়লো আকাশ পথে
কিনতে তারার ফুল
মেয়েটার অঞ্জলিতে গেঁথে
বিষ মাখানো হুল।