সিগারেটে সুখ টানের ধোঁয়া হাওয়ায় মিশে গেলে জয়ার অবয়ব স্পষ্ট হয়। অবশ্য অঘ্রানের শেষ বিকেলে প্রকৃতি একটা ধোয়াশা সৃষ্টি করে। শাওন বলল, ঐ তো জয়া। চন্দন মাথা নাড়ে, প্রকট দৃষ্টিতে জয়াকে দেখে। জয়া তার সালোয়ার, কামিজ, ওড়না বাঁশের আড় থেকে নামিয়ে নেয়, আর চোখ ফেলে এই কালভার্টটার উপর। চন্দন বাড়ীতে আসলে এই কালভার্টটা তার সঙ্গী হয়, আর শাওনতো আছেই। এখানে বসার এই সুবিধে যে, এখান থেকে জয়াদের বাড়ীর পেছন দিকটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। বিকেলের সাক্ষাতটা একটু দূর থেকে হলেও সন্তুষ্ট থকতে হয় ওদের। এটা কি এমন দূরত্ব? চন্দনের বাড়ীর রাস্তা ধরে একটু এগুলে কালভার্ট, তার দু-তিনটে ধান ক্ষেত পরেই জয়াদের বাড়ী। তবে এতটুকু দূরত্বও পছন্দ নয় চন্দনের। এরই মধ্যে জয়া অদৃশ্য হয় হাত নাড়িয়ে। চন্দন এবার আকিজ ধরায়। এ বিষয়ে সে সর্বভূক, কোন বাছ-বিচার নেই। বিড়িতে গাঁজা টানার মত টান দেয় চন্দন। বিড়ি হাত বদল হয়, সুখ টানে সুখ আসে, ঠিক জয়ার মত। ক্লান্ত সূর্য আর আলো দিতে পারেনা। বিস্তীর্ন মাঠে ধান কাটা নাড়ার গোড়ায় আবছা অন্ধকার নামে। শাওন পিঠ চাপড়ে বিদায় নেয় ।
খাওয়া দাওয়া সেরে টেবিলে নোটপত্র নিয়ে নাড়া চাড়া করছে চন্দন, সামনে অনার্স ফাইনাল। বাড়ীতে এসেছে কিছু টাকার জন্য। তবু দু’দিন থেকে যেতে হয় শুধু জয়ার জন্য। সিগারেটের মুখে গ্যাসের আগুন লাগায় চন্দন। অসুবিধে নেই, অনার্স ফাইনাল, কেউ এঘরে অসবেনা। জয়া বিষয়ক ভাবনা গুলোকে প্রিয় নিকোটিন আরও সজীব করে।
দু’বোনের মাঝে জয়া ছোট। চন্দন যখন অনার্স প্রথম বর্ষে তখনো জয়াকে চোখেই পড়েনি ওর। কিন্তু, কিছু দিন পর এমন হলো যে, ওর থেকে চোখ ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। অল্প কয়েকদিনেই ওর মঝে একটা প্রাকৃতিক বিপ্লব ঘটে যায়। তাই ফ্রক ছেড়ে জয়া সালোয়ার কামিজ আর ওড়না ধরে।
জযার বুকে সুখ খোজে চন্দন, স্বর্গের সুখ। লাল-নীল পরীদের রূপ ধরে জয়া ধরা দেয়। চন্দন আর কিছু ভাবার ফুসরত পায়না। তলিয়ে যেতে থাকে গহীন আদিমতায়। ঘন ঘন গরম নিঃশ্বাস পড়ে। বর্ষার ভরা নদী পাড় ভাংতে থাকে। এ ভাঙ্গন কেউ রোধ করতে পারেনা।
কলেজ হোষ্টেলে এ সময়টায় নিঃস্তব্ধতা নামে। বৈকালিক ভ্রমন সেরে ফিরতে রাত ৮/৯ টা বাজে। অবশ্য পড়ুয়াদের কথা আলাদা। হোষ্টেল ভবনের সামনেই বিশাল পুকুর। তরঙ্গহীন জল,ও পাশে নব নির্মিত সুরম্য মসজিদের হাজার ওয়াটের আলো অন্য সময়ের মত জল কেলিতে মাতেনা। পুকুর ধারে ভাবলেশহীন বসে চন্দন ও শাওন। হোষ্টেলের বারান্দায় পা নামিয়ে বসতে ভালো লাগতো। কিন্তু এখানকার বিদ্যার্থীরা অন্ততঃ রাতের বেলা জল বিয়োগটা এখানেই সারে। ফলে পুকুর ধারে বসা ছাড়া উপায় নেই । জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বের করে সিগারেট ধরায় শাওন। ঘন ঘন টান দেয়, ধোঁয়ারা কুন্ডলী পাকায় মাথার ওপর। শাওনের মুখটা বিরক্ত মনে হয়। কারন চন্দন আজকের প্রোগ্রামটা বাতিল করেছে। হ্যা, ছিল রাতে খাবারের পর তারা কেয়ার কাছে যাবে। কিন্তু চন্দন যে কি ভেবে এমন বেকে বসল, তা সে নিজেই জানেনা। সিগারেটটা চন্দনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, কি যেন একটা গাল দিয়ে চলে গেল শাওন।
কথা কেয়ার সাথে কি ওর কোন সম্পর্ক আছে? কেয়া তো সেই অল্প বয়স থেকেই তার কোমল শরীরটাকে পন্য করেছে। আর চন্দনও তো সেখানে বাঁধা পড়েছিল অনেকদিন। খরচের টাকা বাচিয়ে মাসে দ ু একবার ওদিকে গেলে, সে তো কেয়ার খুপরিতেই যেতো। কেয়ার কোমল শরীর পন্য হতে হতে এখন ঢিলে ঢালা রুক্ষ। শাওনের অবশ্য জরিনা, মৌসুমী,শ্যামলী, কলমী যে কেও হলেই চলে। কিন্তু চন্দন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মতে একটু আলাপ পরিচয় হলে কেয়ারা শরীর বৃত্তগুলো আরও জাগিয়ে দিতে পারে। সবকিছু এক ঘেয়েমি মনে হয়। এসব আজে বাজে ভাবনা ঠিক এসময়ে কেন যে তাকে পেয়ে বসেছে, তার কোন স্বাভাবিক কারন সে খোজে পায়না। পুকুর থেকে একটা জলজ বাতাস শরীরে লাগে। কুয়াশারা তাদের আস্তরণ ঘন করে। কেন্টিনে ডাল ভাত খাওয়ার সময় হয় ততক্ষনে।
চন্দন হোস্টেল ছেড়েছে বেশ কিছুদিন। আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে বেড়ানো আর আড্ডায় সময় কেটে যাচ্ছে। এর মাঝে জয়ার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এস.এস.সি উত্তরে জয়া এখন কলেজ, প্রাইভেট নিয়ে মেতে আছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে তার স্বাভাবিক নিয়মে। তবুও জয়ার লুকোনো সমস্ত রহস্য ভেদ করতে থাকে চন্দন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আর গ্রীন লাভের কল্যাণে সকল লালসা ধামাচাপা পড়ে। কিন্তু এর কি কোন পরিণতি আশা করেনা ওরা দুজন?
ঢাকায় একটি কোম্পানিতে ছোটখাট চাকরি পেয়েছে চন্দন। সে কোম্পানির কাজে বেশ ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাচ্ছে আজকাল। তাই বাড়ীতে আসা প্রায় হয়েই ওঠেনা তার। হঠাৎ শাওনের চিঠি। চিঠিটা বার কয়েক পড়ে নেয় চন্দন। কিছুই যেন সে বিশ্বাস করতে পারেনা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা। রতনের সাথে জয়াকে অন্ততঃ ৩/৪ দিন সিনেমা হল থেকে বেরুতে দেখেছে শাওন। বন্ধু মহলেও এ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে কয়েকদিন ধরে।
রতন পাশের গ্রামের ছেলে। বছর পাঁচেক বিদেশ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এসেছে। জয়ার সুখের জন্য বাবা-মা পাত্র হিসাবে রতনকেই পছন্দ করেছেন। জয়াও তাদের মতের বিরুদ্ধে যায়নি। চন্দনকে বিয়ে করলে হয়তো এমন স্বাচ্ছন্দের ছোঁয়া সে কোনদিনই পাবেনা। বাস থেকে নেমে রিক্সায় ফিরছে চন্দন। প্রকৃতি এক করুণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চৈত্রের শুকনো মাঠ ফেটে হা করে আছে। মাঠের দিকে তাকালে কেবল ধোঁয়া ধোঁয়া মনে হয়। রাস্তা ধারের ঘাস গুলো কেমন খসখসে বিবর্ণ হয়ে আছে। রিক্সা ওয়ালা গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে বার বার। রাগে, দুঃখে চন্দনের মাথার নার্ভ গুলো যেন হাই জাম্প খেলছে। চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে যেন।
বিকেলে শাওন এসেছে দেখা করতে। সেই কালভার্টে বসে ওরা তাকিয়ে আছে জয়াদের বাড়ীর দিকে। জয়াকে জানানো হয়েছে দেখা করার জন্য। অবশ্য চন্দন শংকায় ছিল জয়ার সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারে । প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল কিন্তু জয়ার ছায়া পর্যন্ত দেখা গেলনা। সামনে যা ঘটতে যাচ্ছে তা চন্দনের বুঝতে বাকি রইলনা।জয়ার সাথে শেষ কথা বলার যে অদম্য ইচ্ছা তার ছিল, তা ইতিমধ্যেই মিইয়ে গেল। রাগে, ক্ষোভে সে চলে এল ঢাকায়
সপ্তাহ খানেক পর বস বললেন, টাঙ্গাইলে শাখা অফিসে আপনাকে কাজ করতে হবে। আগামী মাসের ১ তারিখে ওখানে জয়েন করবেন। টাঙ্গাইলে চলে এল চন্দন। অবশ্য আগে দু’একবার সে এখানে বেড়াতে এসেছিল। মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত চন্দন। শহরটা ঘুরে ফিরে দেখলে মনটা একটু হালকা হতে পারে, এই ভেবে সে বেড়াতে বেড়িয়েছে। হাটতে হাটতে অনেকটা আনমনা হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ একটা জায়গার পরিবেশ পরিচিত মনে হলো তার। কিছু না ভেবে সে ভেতরে চলে এল। একটা ১৪/১৫ বছরের মেয়ে এগিয়ে এসে বলে-
আমি মায়া। আমার আম্মারে আপনে চিনবেন। তার কাছে আপনে প্রায়ই যাইতেন। হে ছয় মাস অয় আমারে এইহানে পাঠাইয়াদিছে।
চন্দন এতক্ষনে সবই বুঝতে পারে। বেড়িয়ে আসার জন্য পা বাড়ায়। মেয়েটি তার হাত চেপে ধরে বলে,“ চইলা যাইতাছেন যে, এইহানে মা- মেয়ের মইধ্যে কোন পার্থক্য নাই।” এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে চন্দন রাস্তায় নেমে এল………..।