শাখাওয়াত বকুলের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘাম ও সাদা মেঘের ঘ্রাণ’। শাখাওয়াত বকুল গল্প লিখেন বর্তমান কে ধারণ করে। অতীতের স্মৃতির বিলাপ তার গল্পে অল্পই পাওয়া যায়। তার নিজস্ব ভাষা আর অকপটে সত্য বলার রীতি মুগ্ধ করবে সবাইকে। এই গ্রন্থে রয়েছে নয়টি গল্প। গল্পগুলো আকারে ছোট। কিন্তু চটপটে ভাষায় তিনি পাঠককে দেখিয়েছেন বহু নৈর্ব্যক্তিক সত্য। আমাদের দেখাকে তিনি নতুনভাবে দেখিয়েছেন। চিন্তাকে বাজিয়ে দিয়েছেন আবার। ক্রমান্বয়ে প্রতিটি গল্প নিয়ে আলোচনা করছি।
‘অমাবস্যার চাঁদ’ গল্পটি ক্যান্সার আক্রান্ত একজন মানুষের জীবন নিয়ে। খুবই ছোট গল্প, তবুও কি বোধ! কঠিন রোগাক্রান্ত মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের তাড়না কম। অতীতের ছলছল স্মৃতি কিংবা সুখের প্রেরণাদায়ক গল্পগুলোই তাদের ভাবুক করে তোলে। কিংবা আশাবাদী কল্পনা-স্বপ্ন। ক্যান্সার আক্রান্ত আনোয়ারের সকল চিন্তার মাঝেও আছে পুরোনো প্রেমিকার জন্য বিশেষ কল্পনা। তার প্রেমিকা পুরোনো। বিয়ে হয়ে গেছে অন্য কোথাও, কোনো এক ধনী রশিদের সাথে। তবুও তার আগমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অপরিণত প্রেমের মমত্ব-ভালোবাসায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে না বলেই মানুষের প্রেমিকার থেকে অনেক বেশি প্রত্যাশা থাকে। এই প্রত্যাশিত মমত্বই যেন সবচেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষিত যা সমুদয় তীব্র ব্যথার সমাপ্তি ঘটাতে পারে।
পালক গল্পটির ভিতরে যে ইনসাইট দেখতে পাই একে কবিতার মতো মনে হয়। এই গল্পে কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র নির্মাণ করা হয় নি। বরং একটি পাখির শুভ্র পালককে কেন্দ্র করে যেই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখক তৈরি করেছেন তা যেন আমাদের সমকালের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
পরের গল্পটি ‘দীর্ঘশ্বাস ও নিঃশব্দের গল্প’। গল্পে বর্ণিত হয়ে করোনা মহামারীকালীন লকডাউনের কাহিনী ৷ মসজিদের একজন ইমাম আশরাফুলকে সাহায্য করতে হয় তার বিয়ে না করা এক মহিলাকে যার স্বামী গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে লিখেন। পরবর্তীতে তাকে একদল নাম পরিচয়হীন মানুষ ধরে নিয়ে যায়। কেউ একজন সেই মহিলাকে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে তা জানায়। আশরাফুলের স্ত্রী অসুস্থ। তারা দুজনেই রওনা হয় ঢাকায়। লকডাউন সময়ে যাতায়াত ব্যবস্থা যে মোটেও সহজ ছিলো না তার বর্ণনা স্পষ্ট হয়ে এসেছে তাদের বার বার যানবাহন পরিবর্তন করার দ্বারা। গন্তব্যে পৌঁছে গেলে আশরাফুলকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্ষত বিক্ষত হয় তার শরীর। অবশেষে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে আশরাফুল যখন তার স্ত্রীর বাসায় যায় তার স্ত্রী রক্তাক্ত আশরাফুলের পিছনে আগন্তুক মহিলা দেখে বিস্ময়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তিনি লক্ষ্যই করেননি মহিলার পিছনে তার স্বামী। এই গল্পটি আমার কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ লেগেছে। প্রথমত মহামারী সময়ে মানুষ কষ্টকর চলাফেরা। দ্বিতীয়ত ফেসবুকে লেখার কারণে ধরে নিয়ে যাওয়া। করোনা মহামারী গত হয়েছে। এর অভিজ্ঞতা মহামারীকে জয় করা সকল জীবিত মানুষেরাই পেয়েছে ৷ কিন্তু গত হয়নি মতপ্রকাশের কারণে ধরে নিয়ে যাওয়ার শংকা। পাশাপাশি আশরাফুলের স্ত্রী যেন বোধহীন, দুর্বলচিন্তা শক্তি সম্পন্ন সাধারণ মানুষেরা। যারা বড় সমস্যার অন্তরালে ছোট সমস্যাকেই দেখতে পায় বেশি। এই গল্পে দুইজন মানুষের একে অন্যকে আবিষ্কার করার মনস্তত্ত্ব ও ধর্মীয় বোধ থেকে নৈতিকতা রক্ষার মতো সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও ফুটে উঠেছে নিদারুন ভাবে।
‘ঘোরগ্রস্ত স্বপ্ন আর পেরেকের ঘর’ গল্পটিও করোনা মহামারীকালীন সময় নিয়ে লেখা। এই গল্পে উঠে এসেছে এই সময়ের করুন চিত্র। হঠাৎ করে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া আর এরপর কর্মী ছাটাই। এই দুইটি ঘটনা মজুর শ্রমিকদের জীবনে যেই সংগ্রাম এনে দিয়েছিল তা করোনা মহামারীর মৃত্যু উৎসবও ম্লান করে দেয়। এই গল্পে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন পুঁজিবাদ ও ভোগবাদী সমাজের বাস্তব চিত্র। তিনি লিখেছেন- “ পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের পৃথিবীতে শ্রম আর শ্রমিকের মূল্য শুধু উৎপাদনের টুলস হিসেবে”। চটপটে বর্ণনায় লেখক এমনই চাকরিচ্যুত গার্মেন্টসকর্মী জামিলের মাধ্যমে সেই কঠিন সময়ের সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন। এই গল্পটি মহামারী সময়ের ইতিহাস হিসেবেও বেঁচে থাকবে।
নাম গল্প ‘ঘাম ও সাদা মেঘের ঘ্রাণ’। এই গল্পটিও মহামারী সময়ের করুন চিত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়।স্বামীর অপারগতায় এই কঠিন সময়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ বেছে নেয় এক মহিলা। যার ঘরে আছে ১৭ দিনের শিশু সন্তান। একই সময়ে দ্রব্যমূল্যের বাজারও ছিলো অসহনীয়। এরকম সংগ্রামী পরিস্থিতিতে তীব্র রোদে এক মহিলার রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে আসা। তীব্র রোদ আর কষ্টের চেয়ে তার মন থাকে অভুক্ত সন্তানের দিকে। আর এমন অসহায় সময়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজও যেন সদয় হয়। কিন্তু সমাধান কি তা যেন প্রশ্নই থেকে যায়।
‘মেঘের দেশের আদালত’ গল্পে তিনি বিচারহীনতার সময়কে বর্ণনা করেছেন রূপক ভাবে। মেঘের দেশ কি মৃতদের দেশ? নাকি অতৃপ্ত আত্মাদের? প্রতিটি অস্তিত্ব চায় সঠিক বিচার। সঠিক ভাবনা চিন্তা। এর জন্য আশা হতাশা থাকে। এইসব কাল্পনিক চরিত্র দিয়ে সুনাগরিকের অপার আশার কথা লেখক বলে গেছেন সুনিপুণ ভাবে।
‘প্রেম ও উতল হাওয়ায় ভেসে ভেসে যাওয়া’ গল্পটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রার। সবুজ নামের এক গ্রামীণ কিশোরের ফ্যান্টাসি, দুরন্ততা নিয়ে ৷ গ্রামীণ পরিবেশে একটা অনেকটা শেকড়হীন কিশোরের জীবন যাপনের গল্প এটি। সমসাময়িক অন্যান্য ছেলেদের মতো তার ভেতরেও যে প্রোটাগনিস্ট ভাব সেটা সবুজ উত্তীর্ণ করতে চায় তার আইডল বা আদর্শ কিশোর হাসমতের মতো হতে চেয়ে। আর তার চিন্তা, ফ্যান্টাসি সবই নারী কেন্দ্রিক। নারীদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতাই যেন সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতা। এর মোহ যেভাবে দৃঢ় সততার স্তর কিভাবে ভেঙে দেয় তা ফোটে উঠেছে।
‘কাদু কাকার মজমা’ গল্পের বর্ণনাশৈলী আমাকে অভিভূত করেছে। এই গল্পে বর্ণিত হয়েছে কিছু এবস্ট্রাকট কাহিনী। যেমন কাদু নামের সেই ম্যাজিশিয়ান তার ছেলে লালুর কলিজা বের করে আনে আর উপস্থিত দর্শককে টাকা দিতে বলে। পরবর্তীতে তার সন্তানকে পূর্বাবস্থায় জীবিত ফিরিয়ে আনে। আর টাকা না দেওয়া জনতাকে ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে টাকা আদায়। কাহিনীর সাথে কথকের নিজস্ব স্মৃতি থেকে আসা কল্পনা। কিংবা হুট করে সেই লালুর সাথে দেখা হয়ে তার রিকশায় চড়ে কোনো বিস্তীর্ণ মাঠের কাছে যাওয়া এবং হঠাৎই লালু ও তার রিকশার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। এমনই সাদৃশ্যপুন্য ও সুষম বর্ণনা যে তা রিয়ালিটির মতোই মনে হয়। এই গল্পে লেখকের চিন্তার বৈচিত্র্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
সবমিলিয়ে গল্পগুলোতে ফুটে উঠেছে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। এই বর্তমান সময়কে ধারণ করে বেড়ে উঠেছে গল্পগুলো। গল্পের বিষয় বস্তু ও নামকরণ খুবই মৌলিক ও নান্দনিক যা খুবই মুগ্ধতা ছড়াবে সহজেই। লেখক সমসাময়িক বহু সমস্যা দেখিয়েছেন সেই সাথে দেখিয়েছেন সমাধানের পথ। রেখেছেন পাঠকের জন্য চিন্তার জায়গা। কিছু সত্য তিনি উচ্চারণ করেছেন সাহসিকতার সাথে যা বহু লেখক এড়িয়ে যান। নাগরিকের দায়বদ্ধতা থেকে হোক বা একজন লেখকের দায়বদ্ধতা থেকে হোক তার এই উচ্চারণ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সর্বোপরি এই গল্পগুলো পাঠ্য বলেই বিবেচনা করি। সমসাময়িক সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবেই থাকবে ‘ঘাম ও সাদা মেঘের ঘ্রাণ’ গ্রন্থটি, এই প্রত্যাশা।