সকাল সকাল আমজাদ সাহেবের মেজাজ ভীষণ তিরিক্ষি হয়ে আছে। আপন মনেই বকে চলছেন “শালার চাকরী, লাত্থি মারি তোর হোগায়……”। জুনিয়র কলিগ রীণা হালদার অফিসে ঢুকেই আমজাদ সাহেবের একমনে বকা শুনে যাচ্ছেন। ব্যাগ, টিফিন ক্যারিয়ার টেবিলে রাখতে রাখতে রীণা জিজ্ঞেস করল ” কী হয়েছে স্যার? কোন সমস্যা?” আমজাদ সাহেব হাতের কাগজখানা বাড়িয়ে রীণার হাতে দিতেই রীণা দেখতে পেল বদলীর আদেশ। যে শাখায় বদলী হয়েছে সে শাখার মহিলা বস ভীষণ কড়া মেজাজের। রীণা কিছুদিন তার অধীনে কাজ করেছে। সেই বসের সুনাম দুর্নাম উভয়ই প্যারালাল। সুনামের মধ্যে পাংচুয়ালিটি প্রধান। যাইহোক, আমজাদ সাহেবের গজগজ অন্যায় কিছু নয়। ঢাকার বাইরে বহু বছর কাজ করায় সংসার তেমন গুছিয়ে তুলতে পারেননি। এইবার ঢাকায় ফিরে গত তিন বছরে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছেন সংসার। অফিস থেকে লোন নিয়ে পল্টনের দিকে একটি ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবছেন। তার স্ত্রী ছোট মেয়েটিকে ভিকারুননিসা স্কুলে ভর্তি করানোর প্রিপারেশন নিচ্ছেন। এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হাতে এলো বদলীর আদেশ। তাও আবার ঢাকার বাইরে গাজিপুর। মেজাজতো তিরিক্ষি হবার কথাই। বর্তমান ভাড়া বাসা থেকে আসা যাওয়ার অসুবিধা হবে ভেবে বাসা বদল করার সিদ্ধান্ত নিলেন আমজাদ সাহেব। সেই মোতাবেক পরের শুক্রবারেই তিনি স্ত্রীকে ছাড়া একা একাই নতুন অফিসের কাছাকাছি বাসা খুঁজতে বের হয়ে গেলেন। খুঁজতে খুঁজতে চোখ পড়লো সদ্য সমাপ্ত নতুন এক বিল্ডিংয়ের উপর। বাইরের চাকচিক্য নজর কাড়ে খুব সহজেই। সাধ, সাধ্য আর রুচির এক অপূর্ব সমন্বয় যেন। তার উপর বোনাস হিসেবে সামনেই বিরাট এক মাঠ। যেন ঈদ বোনাসের সাথে আরো একটি প্রফিট বোনাস। বাড়ির লাগোয়া চায়ের দোকানী জানাল সম্প্রতিই এক রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার পেনশনের টাকায় সম্পন্ন করলেন বিল্ডিংয়ের কাজ। তবে পুলিশ শুনে কিছুটা দমে গেলেন তিনি। পুলিশ শব্দটিই যেন ‘ঘুষ কিংবা আঠারো ঘা’ শব্দটির সমার্থক। আশ্চর্য! সাথে সাথেই হিপের ঠিক নিচে বেত্রাঘাতের শিরশিরে এক অদ্ভুত অনুভূতি টের পেলেন যেন। হোক না রিটায়ার্ড! শয়তান কি বুড়ো হলেও গাছে ওঠা ছাড়ে? সৌন্দর্য বিপদজ্জনক হলেও এর ডাক এড়ানো কঠিন। তেমনি আমজাদ সাহেবও আঠারো ঘায়ের কথা ভুলে কলিংবেল টিপলেন।বাড়িওয়ালা অর্থাৎ রিটায়ার্ড পুলিশ সাহেবের সাথে কথা বলে বাসা মোটামুটি ফাইনাল করে স্ত্রীকে নিয়ে আসবে বলে বিদায় নিলেন। পরের দিনই স্ত্রীকে নিয়ে এসে এডভান্স ভাড়ার টাকা দিয়ে গেলেন। নতুন বাসায় মালপত্র দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলো। আসবাবপত্র গোছগাছ করতে করতে সন্ধ্যে পার হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ বাইরে হৈচৈ শুনে বারান্দায় এসে আমজাদ সাহেবের চক্ষু ছানাবড়া। জমজমাট বাজার বসে গেছে রাস্তায় ও মাঠে। প্রতিটি বাড়ির নীচে অস্থায়ী দোকান খোলে বসেছে দোকানীরা। উচ্চ ভলিউমে গান বাজছে। আসল সমস্যা শুরু হলো রাত বারোটার পর। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। সারা রাত নির্ঘুম কাটালেন তারা। কুকুরের গলায় এতো জোর এখানে না এলে বুঝাই যেতো না। অথচ লোকে বলে চোরের মার বড় গলা! পাড়ার নাম আনন্দ বাজার। প্রথম যেদিন সকাল থেকে দুপুর অব্দি টু-লেট দেখে দেখে সারা পাড়ায় ঘুরেছিল, বাজারের চিহ্নও চোখে পড়েনি। এমনকি পরের দিন তার স্ত্রীকে নিয়ে যখন এসেছিল তখনও কোন বাজারের নিশানা ছিল না। শুধু ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি চায়ের দোকান ছিলো যা প্রতি পাড়ায় যেমন থাকে। আসলে বাজার বসে সন্ধ্যার পর। সকালে অফিসে যাওয়ার পূর্বেই তিনি বাড়িওয়ালার নিকট জানতে চাইলেন কুকুর সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়। তিনি দুই কানে তুলা গুজার পরামর্শ দিলেন। সে না হয় রাতের বেলায় গুজে শুলেন। কিন্তু দিনের বেলায় কী করবেন! আমজাদ সাহেব জানেন কুকুরের কামড়ে নাভীর গোড়ায় চৌদ্দটি ইনজেকশন নিতে হয়। ভাবতেই হিপের শিরশিরানী নাভীতে ওঠে এলো। ছুটির দুই দিন পার হলো। পরের দিন অফিসে যাবার জন্য যেই তিনি গেট খুললেন, অমনি দুটি কুকুর ক্যাঁ ক্যাঁ শুরু করে দিল। কুকুরের ক্যাঁ….এ ক্যাঁ…..এ শব্দ এতোটা কর্কশ হয়, কাছ থেকে না শুনলে বিশ্বাসই হতো না। রাস্তাঘাটে নেড়ি কুকুর দেখেছেন, অল্পেই ঘেউ ঘেউ করে ক্ষান্ত দেয়। কিন্তু এখানকার কুকুরগুলো যেন অন্যরকম! একবার চিৎকার শুরু করলে থামতে চায় না। খানিক পর পরই ক্যাঁক… ক্যাঁক…. ক্যাঁক….করতেই থাকে। স্থানীয়রা একে “কেডি কুত্তা” বলে ডাকে। যদিও দশটায় অফিস, প্রথম দিন বলে সাড়ে নটায় তিনি অফিসে পৌঁছে গেলেন। অফিসে গিয়ে আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা। যেমন শুনেছিলেন বসের কথা! ছোটখাটো মহিলা বস সমানে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছেন সামনে দাঁড়ানো দুইজন অফিসারের সাথে। কিছুক্ষণ পর পরই কোন না কোন ভুল ধরে দাঁত মুখ খিঁচাচ্ছেন। আমজাদ সাহেবের নিকট সকল কলিগদের যেন কারাবন্দী মনে হলো। বেলা সোয়া দশটায় আরেক দফা ক্যাট ক্যাট শুরু হলো। কোন একজন মহিলা কলিগ অফিসে আসতে পনের মিনিট লেট করেছেন। বেচারী অপরাধী হয়ে নীচের দিকে চেয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ম্যাডাম চিৎকার করেই যাচ্ছেন। দুপুর পার হয়ে যাচ্ছে। লাঞ্চের ব্যাপারে কারো কোন তৎপরতা নেই। এদিকে আমজাদ সাহেবের পেট ক্ষিধেয় জ্বলছে। কাঁচ ঘেরা চেম্বার থেকে বিকট স্বরে কর্কশ আওয়াজ না আসলেও হালকা চিক চিক শব্দের সাথে ম্যাডামের দাঁতমুখ খিঁচানো চেহারা দেখা যাচ্ছে। হয়তো কোন কলিগের ভুল পেয়েছেন। তাই ক্ষেপেছেন। নতুন অফিসে এমনিতেই মন বসেনা, তার উপর এমন গোলযোগ এরই মধ্যে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি একমনে চেয়ে রইলেন স্বচ্ছ কাঁচঘেরা চেম্বারের ভেতর। চেয়ে থাকতে থাকতে তিনি ভেতরের সব ডবল দেখতে পাচ্ছেন। সেই ডবল দৃষ্টিতে কাঁচ ভেদ করে, বসের ডবল মুখ ভেদ করে তার চোখে যেন ভেসে ওঠল রাস্তায় ক্যাঁক.. ক্যাঁক… করা সেই “কেডি কুত্তা”র মুখটাই।
64
সানিয়া আজাদ
জন্মঃ ১৯৭৫ সালের ২৯শে জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে। পড়াশোনাঃ ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স। কর্মক্ষেত্রঃ পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের এজিএম হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় সংসার ও সন্তানদের মানুষ করার তাড়নায় চাকুরী ছেড়েছেন। তবে অবসরে লেখালেখি ও হোম ইন্টেরিয়রের কাজ করতে পছন্দ করেন। শখের বশে ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং এর সাথে জড়িত থাকলেও তা প্রফেশনালি করার ইচ্ছা রয়েছে।
previous post
বিধ্বংসী WL 261 ও অন্যান্য
next post