কীর্তনখোলা নদীর পারে জেলা শহরের একেবারে প্রান্তের এই বিজনতায় গোরস্থানের কিনারে মহাকালের সমস্ত সুষমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক শিলকড়ই। পাঁচজন লোক হাত ধরাধরি করেও কড়ইটির বেড় পাওয়া যায় না, এমনই অতিকায় সে। সন্ধ্যার অনেকটা আগে থেকেই কড়ইতলার ঘাটে নাও ভিড়িয়ে ওদিকটায় ঘুরঘুর করছে কেরায়া নাওয়ের মালিক মনা। কিছুটা অস্থিরতা নিয়ে সে তার দোস্তের জন্য অপেক্ষা করছে। তার দোস্ত আশরাফ আরও দুজনের জন্য অপেক্ষা করে করে বড় রাস্তার দিকে গেছে সেই কখন।
একটু আগেই মাগরিবের আজান পড়েছে। আকাশ কালোকরা ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসে ঢেকে দিচ্ছে চারদিক। থমথমে গোরোস্থানের কাঁটাঝোপে পতঙ্গ ডাকতে শুরু করেছে। গর্তের বাইরে বের হয়ে শেয়ালেরা ইতোমধ্যে লোকালয়ের দিকে চলে গেছে।
কড়ইগাছে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য পক্ষীর হল্লা এখনো থামেনি অথচ কেরায়া নাওয়ের মালিক কবির আর মনার দুখান নাও ছাড়া এই ঘোর—সন্ধ্যায় কড়ইতলার ঘাট আজ ভয় ধরানোর মতোই বিরান।
কীর্তনখোলা নদীর পারে জেলা শহরের এমন বিরানে এই বিশাল শিলকড়ইটির ইতিহাস কেউ জানে না। হঠাৎ যারা প্রথম এদিকটায় আসে বৃক্ষটির আকার—আয়তন দেখে একেবারে ভিরমি খায়, একটা অনুমান নিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেÑ এর বয়স নিদেনপক্ষে সাত—আট শ বছর তো হবেই!
আর এই কীর্তনখোলার ভাঙা পাড়, জলের দাপটে ভাঙতে ভাঙতে যা আজ এইখানে এসে থেমেছে, অতীতে তা কত দূরে, কোথায় ছিল, তারও কোনো ইতিহাস কেউ খঁুজে দেখেনি কোনো দিন। দেখার প্রয়োজন বোধও করেনি। বলাবলি যা হয় সবটাই আনাড়ি আন্দাজ।
ভাঙা—গড়ার বাঙ্গালার জনপদ চিরকালই এমন ইতিহাসবিমুখ। তবে এখনকার বয়ষ্ক মানুষজন যখন বাড়ির দাওয়ায় বসে হুঁকো টানতে টানতে গালগল্পে তাদের পূর্বপুরুষের কেচ্ছা তোলে, বলে, ‘বাপ—দাদায় যেই কীর্তনখোলার কতা কইতো, হেই গাঙ কি আর আছে, ব্যাডা! এই পাড়ে খাড়াইয়া হেই পাড়ে কিচ্ছু ঠাহর অয় নাই, এমনই আছেলে হেই গাঙ। আর কী যে সোত, আর কী ঢেউ আছেলে হেই গাঙ্গের!’
তখনকার কীর্তনখোলায় যত রাতই থাকুক না কেন, যত ঢেউই উঠুক, আজ তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবুও আজকের কীর্তনখোলা নামডাকে এখনো কীর্তনখোলাই।
নদীটার ভাঙা পাড়ের এঁটেল মাটি ভাঙতে ভাঙতে আমাদের প্রাচীন এই শিলকড়ইয়ের কয়েকটি বিকট শিকড় আর ওই শিকড়ের বিস্তর ডালপালা জলে বার করে দিয়ে থেমে গেছে। এখনও বাতাস বেড়ে গেলে নদীর জলের উল্লাস এসে আছড়ে পড়ে ভাঙা পারের খাড়িতে, গাছটার শিকড়ে। কিন্তু এই পার এখন আর ভাঙে না। মানুষের বিশ্বাস শিলকড়ই বৃক্ষই থামিয়ে দিয়েছে এদিককার ভাঙন। আচ্ছা, শিলকড়ই কি আছড়ে পড়া জলের এই উল্লাস অনুভব করে? সে কি আমোদিত হয়? হয়ত—বা করে। হয়ত—বা হয়। তার শিকড় থেকে দড়ির বাঁধন খুলে কে কখন কোন উদ্দেশ্যে কোন দিকে নাও ভাসায় বা নাও বেয়ে এনে বাঁধে, কারা এসে তার ছায়ায় বসে, সময় ফুরিয়ে গেলে আবার চলেও যায় সবার মনের খবর কি সে রাখে? মানুষের বিশ্বাস শিলকড়ই সব খবরই রাখে। শত বছরের শতলক্ষ সাক্ষ্য নিয়ে নীলকণ্ঠ সে, সময়ের ছবির মতোই সুস্থির এক ছায়াবৃক্ষ।
কড়ইতলার এই ঘাট কোনো প্রতিষ্ঠিত ঘাট নয়। গোরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে পায়ে দলা একটা ক্ষীণ পথ জেগে উঠেছে। এই পথে নদীপাড়ের হাওয়া খোঁজা আয়েশি মানুষের বিরামের একটা নির্জন জায়গা কোন কাল থেকে কে জানে ক্রমে নাওঘাটে রূপান্তরিত হয়েছে। আসল ঘাট এখান থেকে পোয়া মাইল উত্তরে। ঘন গাছপালার ওধারে। সেখানে ভেড়ানো আছে বিরাট দুটি জেটি। তার একটা অন্যটার চেয়ে কিছুটা ছোট। জেটির পাশেই অসংখ্য সিঁড়ির শানবাঁধানো ঘাট, নানা পদের মানুষের আড্ডা সেখানে। গোসল করা, কাপড় কাচা, যাবতীয় ধোয়াধুয়ির হুল্লোড়ে, ঠেলাঠেলিতে সব সময় অস্থির হয়ে থাকে সে ঘাট।
বড় জেটিতে স্টিমার ছাড়া আর কিছু ভেড়ে না। ছোটটায় ভেড়ে লঞ্চ আর ট্রলার। কেরায়া আর ডিঙ্গি নাওগুলো নিয়ে মাঝি জেটির কাছাকাছি প্রায় দশ—বিশ হাত জলের তলায় লগি কুপে ভেসে থাকে। লঞ্চ, স্টিমার কিংবা কোনো ট্রলার এলেই লগি তুলে নদীর ঢেউ তোলা জলে মোচার খোলের মতো দোল খেতে খেতে ওগুলোর গায়ে গিয়ে ভেড়ে। তখন কে কোন প্যাসেঞ্জার থুয়ে কোন প্যাসেঞ্জারের মালসামান ধরবে, তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় হাঁকডাক আর দরাদরি।
কিন্তু কড়ইতলার এই ঘাটে ওসবের বালাই নেই। এই শান্ত—সমাহিত প্রায় জনমনুষ্যহীন নদীর কাঁধারে এই কড়ইয়ের ছড়ানো শিকড়ে দড়ি বেঁধে গুটিকয় নাও যদিবা থাকে, তাদের কারো কারো উদ্দেশ্য সমাজলগ্ন নয়। যারা জানার, তারা এসব জেনেও শর্টকাট রাস্তা খঁুজতে যাত্রী নিয়ে এ ঘাটে এসে নাও ভেড়ায়। নাও ছেড়ে চলেও যায়। আবার কেউ কেউ এসে নদীর হিমেল হাওয়ায় কড়ইয়ের ছায়ায় নিরিবিলিতে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
এখান থেকে একটু দক্ষিণে, ওই যে দেখা যায় ভাঙন শেষে আবার চর পড়তে শুরু করেছে যেখানটায়, তার থেকেও কিছু দূর এগিয়ে কৈবর্তপাড়া। ধীবরদের গ্রাম। ওটাকে গ্রাম বলাটাও সঙ্গত নয়। কারণ, নদীর চরের জল ছুঁয়ে বাঁশ পুঁতে কিছুটা উঁচুতে ঘর তুলে আদিম অকৃত্রিম ভঙ্গিতে অনেককাল ধরেই তারা ওখানটায় বসবাস করছে। বংশপরম্পরায় মাছ ধরে আর মাছ বেচে নিজেদের কর্মপরম্পরা বজায় রেখেছে। তাই তাদের ছোট্ট পাড়াটাকে আর যা—ই হোক, কেউ গ্রাম বলতে চায় না।
ওই পাড়ার মেয়ে কুসুমকুমারী, ছেলেবেলায় একটা সাহায্য সংস্থার প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়ার পর মাধ্যমিকে আর যেতে পারেনি। বই—খাতা রেখে বাবা—মায়ের একমাত্র সন্তানকে অভাবের সংসারেই নিবিষ্ট হতে হয়েছে। ওর গায়ের রংটা একটু কালো হলেও দিনে দিনে ভয়ানক সুশ্রী হয়ে উঠেছিল সে। সেই সৌন্দর্য এখনো অটুট এবং অম্লান। পোক্ত বাঁশের মতো টনটনা তার শরীর। মাথাভরা ঘন দীর্ঘ কালো চুল। চোখ দুটোও যেমন তীক্ষè, তেমনি তার চটক। যখন সে মাথার ওপর মস্ত খোপা বেঁধে, কপালে একটা টিপ লাগিয়ে ওই চোখের পাপড়িতে কাজলের রেখা টানে, যেদিকে তাকায়, বুঝি—বা বিদ্ধ করে ফেলে।
এই ঘোর সন্ধ্যায় গোরস্থানের বা—দিক থেকে কুতকুতে ঘনায়মান আঁধার ঠেলে কাকে যেন সঙ্গে করে কড়ইতলার ঘাটে এসে দাঁড়ায় কুসুম। ছায়ার মতো দুটি মানুষ। নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বিনিময়ের পর শিলকড়ইয়ের শিকড় ধরে মনার কেরায়া নাওখানায় ওঠে। দড়ির বাঁধন খুলে দিয়ে হারিকেন ধরায়। বৈঠা নেড়ে নেড়ে নিস্তরঙ্গ মাঝগাঙের দিকে ভেসে চলে তারা। কাঁধার থেকে ওই দূরে অন্ধকারে ভেসে চলা নাওখানাকে একটা আলোর ফুটকির মতো লাগে এখন। রাতের আঁধারে এমন গাঙে নাও বাওয়া সোজা কথা নয়। কিন্তু নারী হোক কী পুরুষ কৈবর্তপাড়ার কিংবা এদিককার যে কেউই এইটুকু বাওয়া—বাওয়িতে অভ্যস্ত। অন্য নাওখানা তখনো ঘাটে বাঁধা। ওই নাওয়ের মাঝি কবিরও হয়ত খদ্দেরের অপেক্ষায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশে কোথাও।
এতক্ষণে মাঝগাঙে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নাওয়ে এবং কৈবর্তপাড়ার ঘরে ঘরে, যদি ওগুলোকে ঘর বলি, কুপি আর হারিকেনের আলো পিটপিট করতে আর বাকি নেই। বৈদ্যুতিক বাতির যত রোশনাই জ্বলজ্বল করছে উত্তরের ওই জাহাজঘাটে, জেলা শহরে।
দূরদূরান্তে ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত লঞ্চগুলোর সার্চলাইটও এখন জ্বলছে আর নিভছে। কুসুমের নৌকা ওদিকে গিয়েছে বলে মনে হয় না। মাঝগাঙের দিকে গিয়ে অন্য নাওয়ের আলোর ভিড়ে হারিয়ে গেছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এমন অন্ধকারে কিংবা চাঁদ উঠলে তার ফকফকা জোছনায় শিলকড়ইয়ের ঘাট থেকে এমন নৌযাত্রা স্বাভাবিক নয়। এগুলো এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
ঘন্টা দুয়েক পরে কুসুমের নাও যখন ফিরে আসে, তখন কৈবর্তপাড়ার অনেক আলোই নিভে গেছে। আসলে সন্ধ্যার পর কাজকর্ম সেরে রাতের আহারের পর থালাবাটি গোছানো হলে এরা যখন শুতে যায়, মা যখন দুধের বোঁটা মুখে পুরে দিয়ে শিশুকে ঘুম পাড়াতে থাকে কিংবা আলোর শিখাটি নিভিয়ে স্বামীর সঙ্গে সহবাস শেষে ক্লান্ত রমণী শিথানের বালিশে চোখ বোজার চেষ্টা করে, তখন কতই—বা আর রাত!
তা রাত যা—ই হোক, নাওখানা ঘাটে বেঁধে হারিকেনের ম্লান আলোয় টাকাগুলো গুনে নিয়ে সঙ্গীটিকে ছেড়ে দেয় কুসুম। আলো নিভিয়ে নিজেও ধীরে ধীরে নাও থেকে উঠে আসে নদীর জল—হাওয়া আর গাঢ় অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে। ওদিকে গোরস্থানের দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছিল দুজন। তাদের একজন আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটে শেষ দুটান দিয়ে মুথাটা ছুড়ে মারে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে ঘাটের দিকে। কুসুম বুঝতে পারে ও আর কেউ নয়, মনা মাঝি। ওকে নাওয়ের ভাড়াটা বুঝিয়ে দেয় সে। ঘাটের অন্য নাওটিও এখন আর ঘাটে নেই। ওই নাওয়ের মাঝি কবির আছে হয়ত আশপাশেই। মনা এগিয়ে এলেও ওর সঙ্গীটি গোরস্থানের দেয়ালের ওদিকে দাঁড়িয়ে এখনো সিগারেট টেনে যাচ্ছে। এইটুকু দূর থেকে ওকে চেনার উপায় না থাকলেও কুসুম জানে ওটা আশরাফ।
বছর দেড়েক আগের এক ঘূর্ণিঝড়ে কোথা থেকে উড়ে আসা কোনো একটা চালের টিনে গলাটা দুভাগ হয়ে গেলে কৈবর্তপাড়ার তাগড়া জোয়ান সোমেন তখনই প্রাণ হারায়। সেই ঝড় তো থেমেছে কিন্তু ছয় মাসের শিশুটিকে নিয়ে কপালের সিঁদুর মুছে, হাতের শাখা ভেঙে সদ্য রাঁড়ি হওয়া কুসুম কী করে তখন? দিন আর চলছিল না তার। বাবার ঘরেই উঠতে হয়েছে শেষে। বুড়ো বাবা নীলরতন প্রতিদিন যেটুকু মাছ ধরে আনে, তাই নিয়ে খুব ভোরে বাজারে গিয়ে এক বেলা মাছ বেচে আসে সে। এতে বুড়োর সময় যেমন বাঁচে, জানও বাঁচে। আশরাফের সঙ্গে ওই মাছের বাজারেই পরিচয় হয়েছিল কুসুমকুমারীর।
কৈবর্তপাড়ার বা আশপাশের ছেলে নয় ওরা। টাউনের কাছে বাজারের ছেলে। খদ্দের ভজিয়ে নিরাপদে এনজয় দেওয়ার যেটুকু ব্যবস্থা দরকার, সব করে দিয়ে দুপয়সা রোজগারের আশায় অভাবে পড়া যুবতী মেয়েগুলোকে হাত করাই ওদের ধান্দা। এতে যার যার দিক থেকে লাভ তিন পক্ষেরই। এই লাভের মোহে সমাজের ভয়, পুলিশের ভয় বাঁচিয়ে, আগ—পিছ না ভেবে কেউ পেটের দায়ে, কেউ শরীরের টানে এমন অভিনব পন্থায় নেমে পড়েছে।
কলার ঝোপটা পেছনে ফেলে গোরস্থানের ছাতলা পড়া দেয়াল ধরে আশরাফের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় কুসুম। বলে, ‘ওই বদ ব্যাডারে আর আনবা না কইলাম। মাইয়ামানুষ পাইলেই অইছে! শুয়ারের বাচ্চা একখান। হারামির হারামি, বজ্জাত ব্যাডা!’
‘ক্যান ক্যান, হ্যায় কী হরছে? কঅ না মোরে।’ এমন করে জানতে চাইলেও অকস্মাৎ কুসুমের ঝামটা খেয়ে কিছুটা থতমত আশরাফ। কী বলবে বুঝতে না পেরে মেয়েটার পিছু ধরে সে। ইনিয়ে—বিনিয়ে বলে, ‘অরে শ্যাতাইয়া রাখমুআনে। অসুবিধা নাই, বুঝামুআনে।’
অন্ধকারে লতাপাতা সরিয়ে পায়ে দলা পথ পার হয়ে বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে বড় রাস্তায় ওঠার জন্য হাঁটতে থাকে দুজনে। হাঁটতে হাঁটতেই আশরাফ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তোর বাসনায় তো ব্যাডায় এক্কেরে পাগল অইছে রে, কুসুম। কাইল না অইলে পশশু আবার আইতে চায় যে, কমু?’
চলতে চলতেই আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে কাজলটানা চোখ দুটো তুলে কটমট করে তাকায় কুসুম। অন্ধকারে কথা ছাড়া আর কিছুই তো ফোটে না চোখে। ফুটলে আশরাফ বুঝত কুসুমের ওই চাউনিতে কী ছিল। সে নিরুপায়ের মতো আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘কী, কমু?’
‘না, কওনের কাম নাই। পোলাডার গাখানা গরম দেইখ্যা আইছি আইজ। আমি যাই।’
কুসুমের চলার গতি ক্ষিপ্র হলেও পিছু ছাড়ে না আশরাফ। সে—ও পা চালিয়ে পিচঢালা বড় রাস্তায় উঠে এসে পথ আগলায়, ‘টাহা তো কম দেয় নাই ও, কথায়—কামে ফারাক তো করে নাই মান্নানে।’
‘ধোয়া তুলসী অউক, তর মান্নানের লগে হুমু না আর।’
‘টাহা বাড়াইয়া দিতে কমুআনে। আল্লার কছম, চেতিছ না তুই।’
কিছুতেই বিষয়টা পরিষ্কার হয় না আশরাফের কাছে। দ্রুত পা ফেলে ছোড়ভঙ্গ হয়ে চলে যায় কুসুম। ওর যাওয়ার পথে বেকুবের মতো হাঁ করে যে তাকিয়ে থাকবে, সে উপায়ও তো নেই, এখন এতই অন্ধকার।
এরই মধ্যে মনা এসে আশরাফকে খুঁজে নিয়ে গাঙের কাঁধারে ফুরফুরে হাওয়ায় কিছুটা সময় জিরিয়ে নিতে সিগারেট ধরিয়ে কড়ইয়ের একটা শিকড়ে গিয়ে বসে।
এখন বড্ড শান্ত গাঙ। ঝিরঝিরে হিমেল হাওয়া জলের ওপর ঝালর মেলে উড়ে উড়ে আসছে। গাঙজুড়ে অসংখ্য নাওয়ের বাতি জ্বলছে আকাশের তারার মতো পিটপিট করে। সবই এদিককার ধীবরদের নাও, দিনে তো ধরেই, রাত জেগেও মাছ ধরে ওরা।
গাঙের অপর পারে, শিয়ালকাঠির গ্রামগুলোর পেছনে গাছপালার মাথায় একটু পরই আকাশ আলো করা হলদে চাঁদ উঠবে। তখনো কি শিলকড়ইয়ের শিকড়ে পাছা ঠেকিয়ে বসে থাকবে দুজনে? এভাবে বসে থাকলে বোচা ব্যাপারীর আখড়ার ঝাঁপ আটকানোর সময় হয়ে যাবে যে! তার চেয়ে ওর ওখানে কোক মিশিয়ে দু—চার পাত্র বাংলা জল গলায় ঢালুক না গিয়ে। গলা না ভিজিয়ে এই অবেলায় বাড়ি ফিরলে মাগির দালালের কি জাত থাকে!
মনার মতো আশরাফের মাথায় কিন্তু ওসব খেলছে না এখন। বরং সে সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে কুসুমের ব্যাপারটা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে থাকে। মনে মনে বলে, ‘ও মোর খোদা, পুরা পেলানডা গোছাইয়া আনার আগেই কেমন একখান প্যাঁচ লাগাইয়া গ্যালে মাগি! এহন উপায়?’ মনাকেও তো এখনো তার প্ল্যানের কিছুই খুলে বলা হয় নাই। তবে বলবে, সময়মতো সব গুছিয়ে বলবে সে। খালেক চেয়ারম্যানের পোলা মান্নানের কাঁচা মাংস খাওয়ার হাউসখান এইবার প্রাণভরেই মিটাবে।
বোচা ব্যাপারীর আখড়ায় বাংলা মদ খেয়ে নেশাটা আজ বেজায় বেসামাল হয়েছে ওদের। ট্যাংট্যাঙা মনারও নিত্য যা হয়, বাঁশের কঞ্চির মতো লকলক করছে সে। পা দুটোকে কোনোমতেই সামাল দিতে না পেরে হোঁচট খাচ্ছে আর মা—বাপ তুলে গালি দিচ্ছে সে। কার মা—বাপকে গালি দিচ্ছে তা সে—ই জানে। অকথ্য, অশ্লীল সে ভাষা, বিশ্রী তার বয়নভঙ্গি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিক্কা উঠছে। প্রতিটি হিক্কায় বাংলা মদের সঙ্গে খাওয়া ঝাল মেশানো কাঁচা ছোলার দানা গলার কাছে উঁকি মারছে। কিন্তু আশরাফের তেমন কিছু হচ্ছে না। সে গুম হয়ে হাঁটতে থাকে। মোষের মতো গাঁট্টা—গোট্টা শরীর। খাটো ঘাড়ের ওপর মস্ত একটা মাথা তার। এমন শরীরে ভালো—মন্দ সবই সয়। কিন্তু বেসামাল নেশা হলেও আজ কেমন থম ধরে আছে সে। যেন ভেতরটাজুড়ে ঝড় উঠবে একটা, এ তারই পূর্বাভাস।
চাঁন্দের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে ওরা মান্দার খালের পুলের ওপর এসে দাঁড়ায়। পুলের নিচে কুলকুল করে ভাটার জল নামছে। আর একটু এগোলেই চৌরাস্তার চক্করের পর আশরাফদের বাড়ি, তার কিছু দূরেই মনাদের। এতক্ষণে মনা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে বলে মনে হয়। যতই পান করুক না কেন, বাড়ির কাছাকাছি এলে প্রতিদিনই ও নিজেকে কীভাবে যেন সামলে নেয়। এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক মনার। সেই ম্যাজিকের জোরে ও এখন নিজের পায়ের ওপর অনায়াসেই দাঁড়াতে পারছে। আশরাফ একটা সিগারেট ধরিয়ে মনাকে দেয়। বলে, ‘একখান পেলানের কতা কিন্তু তোমারে কই নাই, মনা। অহন কমু, মন দিয়া হোনবা।’
মনা সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলে, ‘কও দেস্তো, হুনি তোমার পেলান।’
শরীরজুড়ানো জোর হাওয়া দিচ্ছে এখন। সেই হাওয়ায় কান পেতে থাকে মনা। আশরাফ বলে, ‘মান্নানেরে খতম করতে অইবে। ডরাইও না, কোনো রক্তারক্তির মধ্যে যামু না।’
বুকের ভেতরে বুঝি একটা গজাল ঠুকে দিল আশরাফ! ঘাই খেয়ে আঁতকে ওঠে মনা, ‘কও কী মেয়া!’ তার নেশা এবার পুরোপুরি ছুটে যেতে চায়। বলে, ‘কেন্, হালার পো হালায় কী হরছে?’
‘তোমারে আমারে কিচ্ছু করে নাই, দোস্তো। তয় যারে করোনের, তারে করছে। অনেক উপরের ইশারায় অইতে আছে এই কাম। বোঝঝো?’
ফকফকে জোছনার ছটায় মুখখান বেজার রেখেই প্ল্যানের ভেতরটা বোঝার আগ্রহ দেখায় মনা, ‘তোমার লগে এত পিরিত! খাতির—যত্ন কইর্যা আইজ কুসুমের লগে না হোয়াইলা?’
‘হঅ, হোয়াইছি, কুসুমের রক্ত খাওয়াইছি। এইডাও অইছে ওই পেলান। মাগনা তো আর না। তা ছাড়া খাতির যেটুক আছে, তা তো আছেই, তাতেই—বা কী? মোগো কাম মোরা করমু। হ্যায় কি মোর মায়ের প্যাডের ভাই, নাকি তোমার নাহান জানি দোস্তো, আঁযা?’ বলে শার্টের ভেতর দিকের চোরা পকেট থেকে রবারে প্যাঁচানো পাঁচ শ টাকার অনেকগুলো নোট বের করে মনার হাতে ধরিয়ে দেয় আশরাফ, ‘মোর পেলানমতো খালি কামডা সাজাইবা দোস্তো, ব্যস। নাওয়ের দামসহ আরও পাইবা।’
আশরাফের এমন অবিশ্বাস্য—আজগুবি—ভাওছাড়া কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিতে থাকে মনার। তারপরও এই পরিমাণের টাকার গন্ধ এবং বিগত দিনে দেখা বন্ধুর নিষ্ঠুর চরিত্রের নানান কীর্তি মনে করে নীরবে সায় দেয় সে ‘আইচ্ছা, তুমি য্যামনে কইবা।’ কেননা, একবার যখন বলেই ফেলেছে আশরাফ, তাকে জড়িয়ে প্ল্যান ঠিক করেই ফেলেছে, রাজি না হয়ে এমন একটা বিষয় থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো উপায় নেই তার। তবুও একটা হিজিবিজি পরিস্থিতির মুখে পড়ে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে জানতে চায় মনা, ‘কিন্তু ব্যাপারখান যে বুঝলাম না, খুইল্যা কবা তো, নাকি?’
ওর পিঠে ঠান্ডা হাত রাখে আশরাফ। ‘এতো অধৈর্য অইও না, দোস্তো।’ একটু সময় নিয়ে আবার বলে, ‘তোমার নাওয়ের পাটাতনের নিচে খান বিশেক ইট রাখবা, বোঝঝো? দুই—চাইরখান বেশিও রাখতে পারো। আর নাওয়ের তলায় একখান ফুডা বানাইয়া সোলা হান্দাইয়া থোবা। কাকপক্ষীও য্যান ট্যার না পায়। কুসুম নাও ছাড়ার আগে কায়দা কইর্যা সময় বুইঝঝা সোলাখান খালি তুইল্যা নিবা তুমি, ব্যস। হাঁতার জানে না তো মান্নানে। হালায় তো কুসুমের গন্ধে আউলাইয়া থাকপে। আধা ঘণ্টাও লাগবে না। যারে কয় সলিলসমাধি।’
বলে কি? আশরাফের প্ল্যান শুনে তব্দা ধরে যায় মনার দেমাগে। সে ওর দিকে বেকুবের মতোন হাঁ করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘আর কুসুম?’
‘খ্যামতা থাকলে হাঁতরাইয়া ওঠবে, না অইলে আরও একটা সলিলসমাধি।’ খুব নির্বিকারভাবে বলে আশরাফ।
দুদিনের মধ্যেই কুসুমকে ভজিয়ে ফেলে ছেলেটা। মান্নানকেও পইপই করে সাঁতিয়েছে, যাতে কুসুমের অবাধ্য সে না হয়। নায়ে ওঠার আগেও আশরাফ বলে, ‘কুসুম কিন্তু মোর দিদি, কতাডা মাতায় রাইখ্যেন, মান্নান ভাই।’
শিলকড়ইয়ে আশ্রয় নেওয়া পক্ষীকুলের হল্লা থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। এখন কেবল টাপুর টুপুর বিষ্ঠা ঝড়ছে। গোরোস্থানের ওদিকটায় কথা বলতে বলতে কারা যেন এদিকে আসছে। আঠালো অন্ধকারে আজ নিজের হাতে নাওয়ের দড়ি খুলে দেয় মনা। হাঁটুজলে নেমে অন্য দিনের তুলনায় কিছুটা ভারী নাওখানাকে ধাক্কা দিয়ে গাঙের মধ্যে ঠেলে দেয়। জলের ভেতর পেট ডুবিয়ে আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে নাওখানা।
কীর্তনখোলার ওপারে শিয়ালকাঠির গ্রামগুলোর গাছপালার পেছনে চাঁদ উঠতে এখনো অনেক দেরি। বইঠা ধরার আগে দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকে এখন হারিকেনটা জ্বালিয়ে নেবে কুসুম।
কেমন করে যে একটা সপ্তাহ কেটে গেল! পাঁচ দিন আগে নতুন একখানা নাও কিনেছে মনা। নাও কেনার পর থেকে আশরাফের আর কোনো খোঁজ নেই। কড়ইতলায় এসে খদ্দের ধরবার জন্য একা একা ঘুরঘুর করে মনা। তা ছাড়া আবহাওয়া খারাপ থাকায় গত দুদিন এদিকে আসেনি সে।
একটা অস্থিরতা নিয়ে নদীর কাঁধারে কড়ইয়ের শিকড়ে বসে চিন্তিত মনে একটা সিগারেট ধরায় মনা আশরাফ কি তয় গা—ঢাকাই দেছে? তা তো অওনের কতা না। তেমন কিছু অইলে মোরে একখান ইশারা না দিয়া ভাগবে, এমন ভোদাই পোলা তো সে না। ব্যাপারখান তয় কী? ভ্যাজালখান কোতায়? বিষয়টা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সে। আশরাফের কোনো খোঁজ না পেয়ে কয়েক দিন ধরে উল্টাপাল্টা অনেক কিছুই ভেবে যাচ্ছিল মনা। আজ এখনো ওরকমটা ভাবতে ভাবতেই গাঙের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে আকাশ কালো করে চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, হুঁশেই আসেনি তার! আইজও কি বিষ্টি নামবে? বালের ফাল্গুন—চৈত্রে আসমানের এই ভাবগতিক কারই—বা ভালো লাগে! মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে সিগারেটের মোথাটা গাঙের জলে যেই ছুড়ে ফেলবে, ঠিক তখনই কাঁধের ওপর কাচের চুড়ি পরা মেয়েমানুষের হাতের স্পর্শ পেয়ে আৎকে উঠে পেছন ফেরে মনা। ফিরে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় সে। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠতেই একটা দুঃস্বপ্নের মতো দেখে, আশরাফকে ছাড়াই কৈবর্তপাড়ার মেয়ে কুসুমকুমারী এসেছে একখানা নতুন শাড়ি পরে। তার চোখে কাজল, কপালে টিপ। চেয়ারম্যানের পোলা মান্নানও এসেছে সঙ্গে।