প্রকৃতি সদ্য ঘুম থেকে ওঠে এলো বেশে বাইরে এসে দাঁড়ালো।
ভোর তখন ফুটি ফুটি করে নিজের পাপড়ি মেলে দিচ্ছে, প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সে ফুটফুটে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললো-ঘুম ভাঙলো তবে তোমার! প্রকৃতি অবসন্ন ভাবে মাতা নেড়ে হাই তুললো, তার পর আলস্যভরে দোরের সঙ্গেই যে সজনে ডালটি ক্রমশঃ গাছ হচ্ছিল তার দিকে তাকালো। কবে যে গাছটি ফুলবতী হয়েছে খেয়াল করেনি, আজ দেখলো গাছের ফুল খসে খসে বাতাসে উড়ছে, মাটিতে পড়ছে। প্রকৃতি আনমনা হয়ে যায়। কী যেন ভাবে সে। এমন সময় কোন এক গাছের ফোকর থেকে কোকিলের কণ্ঠ শুনে সে সচকিত হয়ে যায়। এদিক সেদিক তাকায় সে। শিমুলতলায় যে নদীটা রয়েছে তার ঘাটে ফাল্গুন পা ধুচ্ছে, পা ধুতে ধুতেই গান ধরেছে,- এ্যা, ফাল্গুন! তুই কবে এলি?
গাছের মাথা জুড়ে লাল শিমুল ফুঠে রয়েছে সে দিকে তাকিয়ে ফাল্গুন অযথাই এক মিষ্টি হাসি হেসে বললো- এইতো পিসী, এক্ষুনি চলে এলাম।
প্রকৃতি ভ্রুকুচকে বললো- তুই এলি, বসন্ত এলোনা? বসন্তকে সঙ্গে করে নিয়ে এলিনা কেন ফাল্গুন! ফাল্গুন তখন বাতাসের দোলনায় দোর খেতে খেতে হেসে উঠরো, ভোরও হাসছে গালে টোল ফেরে, প্রকৃতি থমকানো দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে ফিরে তাকালো অন্য দিকে ঠিক সেই মুহূর্তে সূরুজ আকাশের নীল চিরে নিজের শরীরের আলো বিচ্ছুরিত করতে করতে ঘোষনা দিলো, সে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। প্রকৃতি অবাক হয়ে গেলো। বললো, কিসের নির্বাচন-?
সূরুজ চোখে হালকা উত্তাপ নিয়ে হাসে। তারপর বলে- অতো কথার কাজ নেই, নির্বাচনে জয়লাভ করেছি এটাই বড়ো কথা, আমার বউ হিসাবে তোমার খুশী হওয়া উচিৎ প্রকৃতি।
প্রকৃতি রুষ্ট চোখে তাকিয়ে দেখে সূরুজকে। সূরুজও আগুন চোখে বলে- সাবধান প্রকৃতি। প্রকৃতি কুয়াশার চাদর ছুঁড়ে ফেলে তার লাল শারীর আঁচল কোমরে পেচাতে পেচাতে বললো- কী করবে শুনি! সূরুজের মনে তখন জয়ের আনন্দ। সৌরজগতের রাজা এখন সে। এই আনন্দের সময় প্রকৃতির সঙ্গে ঝগড়া করার কোন মানে হয়না। সে আপোসের সুরে বলে- বসন্ত আসেনি প্রকৃতি?
প্রকৃতি সন্দেহের চোখে তাকায় স্বামীর দিকে। তারপর বলে- বসন্তকে খোঁজ-খবর করছ কেন সুরুজ, ওকে কি তুমি তোমার মন্ত্রীসভার মন্ত্রী বানাবে? সূরুজ গম্ভীর হয়ে যায়।
বলো- তোমার এত সন্দেহ কেন প্রকৃতি! যেসব অতিথি বন্ধু তোমার কাছে আসে তাদের সৌজন্য কোজ কি আমি বরাবরই নেই না?
–
কী জানি, আমার অতো কথার কাজ নেই, তুমি গোপনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছো,তোমার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই, কোন সম্পর্ক নেই । সামান্য একটা কথা নিয়ে কেন ফ্যাচ ফ্যাচ করছো প্রকৃতি !
মাথা নেড়ে, চুল উড়িয়ে কাঁদতে বসে প্রকৃতি। সে কেন সূরুজের বউ হলো এরকম একটা দুঃখ মনের ভিতর পোষণ করে সে অঝোর ধারায় কাঁদতে চাইলো। দু’চার ফোটা চোখের পানিও ফেললো কিনতু যখন দেখলো সূরুজ তার কান্নাকাটি দেখে পালিয়ে না গিয়ে কৌতুকের হাসি হাসছে তখন প্রকৃতি আর কী করে। ভেজা চোখে সেও হাসে। রং এর ধেনু আঁকে ভ্রুতে। আর ঠিক সেই সময়ই বসন্ত চলে আসে, এসেই অস্থির হৈ-চৈ। ফুল কোথায়? পাখিরা কোথায়? মৌমাছি, প্রজাপতি এদেরকে ডাক প্রকৃতি। প্রকৃতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার পর বিরক্ত হয়।
কতগুলো ছেলে দৌড়ে আসছে, তাদের পেছনে আরও কতগুলো ছেলে।
প্রকৃতি বলে-ছেলেগুলো দৌড়াচ্ছে কেন বসন্ত?
– কে জানে দৌড়াচ্ছে কেন? মানুষের কর্ম বুঝার ক্ষমতা আমার নেই।
প্রকৃতি আকূল চোখে ওদের দিকে তাকায়। ঠা-ঠা শব্দে কানে তালা ধরে যায়। ঝাজে চোখ বুজে আসে। ঠিক সেই সময় প্রকৃতির পা লেপটে তরল গরম কিছু এসে তার পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়।
– কী, এ্যা কী !
প্রকৃতির দেহে ঠান্ডা এক কাঁপন উঠে, শিউরে উঠে সে।
– বসন্ত!
প্রকৃতির গলায় কি ছিলো জানেনা বসন্ত কিন্তু সে চমকে তাকায়। কিযে টুকটুকে বধুবেশ আজ প্রকৃতির, সূর্যের সঙ্গে মহা মিলনের এই দিনে সে এসেছে সাক্ষীর এক মহা মূল্যবান স্বাক্ষর রাখতে কিন্তু তার আজ মন ভালো নেই । কোকিল গাইছে গাক, ফুল ফুটছে ফুটুক, মৌমাছি গুঞ্জন তুলুক, সে সুযোগ পেলেই চলে যাবে, হ্যাঁ সে চলে যাবে মহুয়ার সেই বনে, যেখান থেকে সে এসেছে।
– কি হয়েছে বসন্ত !
বসন্ত হাসে। চৈতালীর ঘূর্ণি নাচে তখন ভয়ঙ্কর তাল এসেছে যে সেই তালে পড়ে চারদিকের ধূলোরা উড়তে লাগলো।ধুলোতে ঢেকে যাচ্ছে প্রকৃতি, ধূলোতে ঢেকে যাচ্ছে বসন্ত, সূর্যটা নেমে আসছে ধীরে, অতি ধীরে। প্রকৃতির আঁচল উড়ছে বাতাসে, বসন্তের মনে এখন ফুলের সৌরভ, সূর্য এখন যাই যাই করছে ঠিক তখনি ঠা-ঠা শব্দ।
ও কিসের শব্দ?
– মানুষ এক প্রকার যন্ত্র তৈরি করে যা দিয়ে মানুষকে হত্যা করা যায় তারই শব্দ, প্রকৃতি।
– এখন কি কোন মানুষকে হত্যা করা হলো?
– হ্যাঁ প্ৰকৃতি ।
– কেন?
আমি জানিনা।
– তুমি এলেই মানুষ মানুষকে হত্যা করে কেন বসন্ত?
– অমি তাও জানিনা প্রকৃতি।
তবে তুমি কি জান?
আমি! ফুল ফুটাতে আর পাখির গান গাওয়াতে জানি।
-হ্যা। বসন্তে তুমি ফল ফলাতে জাননা?
-না প্ৰকৃতি ।
প্রকৃতি অনিমেষ তাকিয়ে থাকে বসন্তের দিকে। বসন্ত চোখ নামিয়ে নেয়।
চৈত্র এসে হাওয়া করতে থাকে তাদের মাথায় । চৈত্রের দাপটে ধূলো উড়ে, গাছের ডাল ভাঙ্গে; এর ভিতর ও শব্দ উঠে মানুষের তৈরি সেই সব যন্ত্র থেকে ঠা-ঠা-ঠা।
প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে যায় ।
বসন্ত চৈত্রকে ফেলেই চলে যেতে উদ্যত হয় তবু সেই যান্ত্রিক ধ্বনি থামেনা, বরঞ্চ বাড়তে থাকে বাড়তেই
থাকে, বসন্তের চলে যাওয়ার পথ ধরে এর এক নহর বয়, এ নহর মানুষের রক্তের, মানুষের রক্ত লাল,
শিমূল কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল, কান্নার শব্দ শুনতে পায় বসন্ত।
কে কাঁদে?
মানুষ মায়েরা!
কিংবা প্রকৃতি!
মা কি প্রকৃতি! আথবা প্রকৃতি কি মা??
প্রকৃতি দেখলো তার পা দু’টো রক্তজবার মত লাল হয়ে গ্যাছে, রক্ত লেখায় রঙ্গীন পা দু’টো দেখে তার মনের ভিতর ঝড় উঠলো। ধূলো উড়িয়ে পাতা উড়িয়ে সে নড়ে উঠলো। বসন্ত বললো-তুই একটু সুস্থির হ প্রকৃতি, সুরুজ দাড়িয়ে আছে তোকে সিঁদুর পড়ানোর জন্য।
প্রকৃতি বোকার মত বসন্তের দিকে তাকালো তারপর সূর্যের দিকে। কিন্তু সূর্যের দিকে তাকাতে পারছেনা আজ প্রকৃতি, কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে তার- বধূ বরণের নতুন বউ যেন সে আজ, এমন দিনেই তো সূরুজ তাকে বধূ হিসাবে বরণ করে নিয়েছিলো। সূর্য তার কপালে, সিথিতে ছড়িয়ে দেয় লাল আবীর রং, প্রকৃতি চমকিত হয়ে বার বার শিউরে উঠে, আবেশে, আবেগে সে দুলতে থাকে- একটি টুনটুনি বসে তার কাঁধে। অনেক বকবকানি তার, চোখ খুলতে বাধ্য হয় প্রকৃতি, বসন্ত তাকে সাজিয়েছে আজ নিজ হাতে, কিযে অপরূপা আজ সে, রঙিন শাড়িতে রঙিলা রূপবান যেন- চুনটুনির কথা শেষ হয়নি, সে বকেই চলেছে এই ফাঁকে সুরুজের দিকে এক পলক তাকাতে গিয়েই খেলো সূরুজ আজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে নরম চাহনীতে। এক নম্বরের বজ্জাত ঐ টুনটুনি পাখীটা। উড়ে দিয়ে প্রকৃতির মাথায় বসলো, সিঁথির সিঁদুরে ঠোঁট ছোঁয়ালো, অঃ টুনটুনি ও তো খাবার নয়, ও যে সিঁদূর-
একঝাক কাক কোথাও থেকে ডাকছে। কাকের ডাক সহ্য হচ্ছে না, আজ এই মহা মিলনের দিনে কাক কেন ডাকবে, বসন্ত! কোথায় বসস্ত বসন্ত তুমি কাকগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে কোকিলের গান বাজাও।
বসন্তের মেয়ে ফাল্গুন এসে বললো- বসন্ত এখন বাড়িতে নেই প্রকৃতি পিসী। সে আমার বোন চৈতালীকে নিয়ে আসতে গ্যাছে, চৈতালী এলেই আমি চলে যাবো ।
–
– কেন যাবি, তুইও থাক পিসীর বাড়ীতে ।
ফাল্গুন ঝড়ো হাওয়ায় বাতাস করতে থাকে প্রকৃতিকে। ফাল্গুন নিজে কম কথা বললেও ওর চোখ দুটো কথা বলে চলে সর্বদাই। মেয়েটি কিছুটা শান্ত আবার কিছুটা চঞ্চল- প্রকৃতি মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকে। ঠিক সেই সময় প্রকৃতি দেখতে পায় মানুষটি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
-কে রে-ও!
ফাল্গুন দক্ষিনের বাতাসের দোলনায় দুলতে দুলতে বললো- ও মানুষ পিসী, ও কবি মানুষ। প্রকৃতি থমকানো গলায় বলে -কবি মানুষ! ও ফাল্গুন তুই এলেই এই মানুষ গুলো আমার কাছে আসে, তুই কি ঐ মানুষ গুলোকে নিমন্ত্রন দিয়ে তবেই আমার বাড়িতে ঢুকিস? ফাল্গুন হাসতে থাকে দুলতে থাকে। প্রকৃতি হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলো ফাল্গুনের দিকে কিন্তু হঠাৎ কিযে কি হলো, হঠাৎ কি এক দূঃখের কথা মনে পড়ে যায়। সে বকতে শুরু করে দেয়, উন্মাদ হয়ে যায়। গায়ের জোরে হিস্ট্রিরিয়া রোগীর মত আছাড়ি পিছাড়ি করে হঠাৎ করেই আবার নীরব হয়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে সে শুয়ে ছিলো, এমন সময় বসন্ত এসে হাক ছাড়ে, ডাকে -ফাল্গুন তুই বাড়ী যা, চৈত্রকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, চৈত্রই এই মাস আমার সঙ্গে থাকবে। প্রকৃতি বসন্তের কন্ঠ শুনে মুখিয়ে উঠলো।
বসন্ত, তুমি হুটহুট করে কোথায় যাও, এই বলে যাওনা, এদিকে রাজ্যের কাক এসে আমাকে যন্ত্রনা
করছে।
– চৈতালি কে নিয়ে এলাম।
বেশ করেছ।
প্রকৃতি বন্ধু কন্যার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসে। তার পর প্রকৃতি বলে-চলোনা বসন্ত নদীর তীরে। চৈতালীর হাত ধরে বসন্ত বললো- চলো।
ওরা নদীর তীরে এসে দাড়াতেই চৈতালী হাওয়ায় উড়িয়ে দিরো নিজের লাল ওড়না, বললো- বসন্ত এসেছে আজ ধরায়।
গাছের বয়স্ক পাতারা অতি ঔৎসুক্যে গলা বাড়াতেই টুপটাপ করে ঝড়ে পড়তে লাগলো মাটিতে, নদীর পানিতে স্তব্ধতা নেমে এলো, প্রকৃতির মেজাজ গরম হচ্ছে কেন কে জানে!
প্রকৃতি ধূসর দৃষ্টিতে চার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো। তার বন্ধু বসন্ত উদাস হয়ে কি যেন ভাবছে, কি ভাবছ বন্ধু আমার?
আমি মানুষের কথা ভাবছি প্রকৃতি।
প্রকৃতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বসন্তের দিকে। কোকিল তার শ্রেষ্ঠ গানটি শুরু করলো এবার, তবুও বসন্ত মন খারাপ করে থাকবে নাকি?
প্রকাশিত হয়েছিল : অতঃপর, গদ্য বিষয়ক ছোট কাগজ, ১ম সংখ্যা, ২০০৩ সন